অজানা প্রতিশ্রুতি

   

আজ অনুরাগের মেজাজ বেজায় গরম। দিনটা শুরুই হলো বিশ্রী একটা ফোন কল দিয়ে। ঘুমের ঘোরে কল রিসিভ করতেই অনুরাগের কানে ভেসে এলো সম্পাদকের রুদ্ধ কণ্ঠস্বর। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঝড়ের গতি তে নিজের বক্তব্য রাখলেন সম্পাদক মহোদয়।

–আর কত সময় লাগবে অনুরাগ তোমার গল্পটা লিখতে?

–ইয়ে…

–পত্রিকাটা যে আগামী মাসের পহেলা তারিখে প্রকাশিত হবে সেইটা আশা করি তোমার মনে আছে। দেখো অনুরাগ, আমি পরিষ্কার বলে দিচ্ছি তোমাকে আরও চার দিন সময় দিতে পারবো। এর মধ্যে যদি লেখা জমা দিতে পারো তাহলে ভালো, না হলে তোমার সাথে আমাদের সব কন্ট্রাক্ট বাতিল করতে আমি বাধ্য হবো। এখন তাহলে রাখছি, মনে থাকে যেন চার দিন সময় রইলো তোমার হাতে।

মোবাইল পাশে নামিয়ে রেখে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো অনুরাগ। অনুরাগ যে খুব জনপ্রিয় লেখক না তা সে নিজেও জানে। বহু প্রকাশক কে নিজের লেখা পাঠিয়েছে অনুরাগ, কিন্তু সবার থেকে একই উত্তর পেয়েছে, “আপনার লেখা ভালোই লাগলো কিন্তু এই গল্প আমরা প্রকাশিত করতে পারব না। আসলে কি জানেন আপনার লেখায় কোনো জৌলুস নেই, এই গল্প পাঠক কে আকর্ষিত করতে পারবে না।“ অবশেষে একটা মাসিক পত্রিকায় লেখার সুযোগ পেল অনুরাগ। এক বছর হলো এই পত্রিকার প্রতি মাসের সংখ্যায় ওর লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। তবুও গত এক বছরে লেখক হিসাবে বিশেষ কিছুই উন্নতি হয় নি অনুরাগের বরং জীবনটা যেন আরও অতিষ্ঠ হয় উঠেছে। আজ সকালের সম্পাদকের হুমকি অনুরাগের জীবনের কোনো অপ্রতিম ঘটনা নয় বরঞ্চ প্রতি মাসের এক বাঁধাধড়া ঘটনার পুনরাবৃত্তি। পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলী এমন ভাবে তাড়া দেয় অনুরাগ কে লেখার জন্য যেন অনুরাগ মানুষ নয় একটা যন্ত্র।

তবুও গত এক বছরের প্রত্যেক মাসেই অনুরাগ নিজের লেখা নির্দিষ্ট সময়সীমার ভিতর জমা করেছে। কিন্ত এই বার মনে হয় তা আর করা হবে না। প্রতি দিনই অনুরাগ লেখার জন্য ল্যাপটপ খুলে বসছে কিন্তু লিখতে কিছুই পারছে না। আসলে ও এমন এক রোগে আক্রান্ত হয় পরেছে যাকে সব লেখক মৃত্যুর থেকেও বেশি ভয় পায়, সেই রোগের নাম হলো ‘রাইটার্স ব্লক’। ‘রাইটার্স ব্লক’ এমন এক মনস্থিতি যখন লেখকের সৃজনশীলতা শিথিল হয়ে পরে এবং লেখক নুতন রচনা গড়তে অক্ষম হয়। এই কারণেই অনুরাগ নিশ্চিত যে ওর পক্ষে চার দিনে গল্প লিখে জমা দেওয়া অসম্ভব।

এমন সময় ফোনের আর এক ঝঙ্কারে অনুরাগের ভাবনার সুতো ছিড়ে যায়। সে তাকিয়ে দেখে ফোন-স্ক্রিনে বিক্রমের নাম ঝলমল করছে। বিক্রম অনুরাগের খুব কাছের বন্ধু কিন্তু আজ মন ভালো না থাকায় ফোন ধরতে ইছা করছিল না অনুরাগের। তবে বিক্রম এমন মানুষ যে ওর ফোন রিসিভ না করলে সোজাসুজি ঘরে এসে হানা দেবে। তাই অগত্যা অনুরাগ কে ফন রিসিভ করতেই হলো। অপর দিক থেকে বিক্রমের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

–কি রে, যাবি তো? না বললেও কিন্তু আমি শুনছি না।

অনুরাগ হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোথায়? কোথায় যাওয়ার কথা আজ?”

–কাল তো তোকে মেসেজ করেছিলাম। দেখিস নি বুঝি?

অনুরাগ দেখেছিল মেসেজ কিন্তু কিছু উত্তর দেয় নি। ভেবেছিল যে উত্তর না দিলে ব্যাপার টা হয়তো এড়িয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সে ভুলে গেছিল যে বিক্রমের হাত থেকে কারোর নিস্তার নেই। বিক্রম নিজের অদম্য স্বভাবের জন্য প্রখ্যাত, ও যা একবার ঠিক করে সেইটা পুরো করেই দম নেয়। ওকে মানা করার সাধ্য কারোরই নেই, অন্তত অনুরাগের তো নেই।

অনুরাগ দেখল এখন সে নিতান্তই বাঘের সামনে এসে পরেছে, পালাবার কোনো পথ নাই। তাই সে ক্লান্ত স্বরে বললো, “হ্যাঁ দেখেছিলাম তোর মেসেজ। ঠিক আছে, তুই তোর গাড়ি নিয়ে আমার এইখানে চলে আয়। একসাথে যাবো।“

–বাহ! এই তো শুনতে চাই ছিলাম। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে গাড়ি নিয়ে আসছি। তুই রেডি হয়ে থাকিস।

 গাড়িতে বসে সারাটা পথ অনর্গল কথা বলে গেলো বিক্রম, কিন্তু অনুরাগের মুখে দু-একবার “হুঁ-হ্যাঁ” ছাড়া আর অন্য কোনো শব্দ ফুটল না। বিক্রমের প্রলাপ শোনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না অনুরাগের, ও কেবল ব্যাজার মুখে জানলার বাইরে চেয়ে রইলো এবং গাড়ি ছুটে চললো তাদের গন্তব্যস্থলে। আজ অনুরাগের মেজাজ গরম হওয়ার প্রথম কারণ ছিল সম্পাদকের ফোন কল এবং দ্বিতীয় কারণ বিক্রমের প্রবল উদ্দীপনা। বিক্রমের এই অদম্য উদ্দীপনার কারণে অনুরাগ কে অনিচ্ছা সত্বেও বাধ্য হতে হলো এমন এক জায়গায় যেতে যেইখানে যাওয়ার ওর কোনো আগ্রহ ছিল না।

 ওদের গাড়ি ছুটে চলেছে এক অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি অফিসারের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ভদ্রলোকের নাম মেজর সান্ন্যাল, ইনি বিক্রমের দূর সম্পর্কের আত্মীয় হন। কিন্তু আজ বিক্রম অনুরাগ কে নিয়ে নিজের আত্মীয়ের বাড়ি কেবল চা জলখাবার খেতে যাছে না; ওরা যাছে এক বিশেষ উদ্দেশ্যে। মেজর সান্ন্যাল জীবনে নানা দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন, এবং তিনি যেই দেশেই গিয়েছেন সেই দেশের কোনো এন্টিক বস্তু কিনে এনেছেন। এর ফলস্বরূপ উনি এখন এক বিস্তীর্ণ এন্টিক সংগ্রহের অধিপতি। তবে সম্প্রতি উনি নিজের এই সংগ্রহ নিয়ে এক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন। সমসস্যা টা ছিল এই যে মেজর সান্ন্যাল চির কালের জন্য দেশ ছেড়ে অসট্রেলিয়ায়ে নিজের ছেলের কাছে চলে যাচ্ছেন কিন্তু ওনার এই বিশাল সংগ্রহ সেই দূর দেশে সাথে নিয়ে যাওয়া নিতান্তই অসম্ভব। ওনার পক্ষে আবার নিজের এই প্রাণের চেয়ে প্রিয় দুর্লভ সংগ্রহ ছেড়ে যাওয়াও সম্ভব ছিল না। অবশেষে এই সমস্যার সমাধানের জন্য তিনি নির্ণয় নিলেন ক্লিয়ারেন্স সেল করার। অতিপ্রিয় কয়েকটি বস্তু বাদে প্রায় পুরো সংগ্রহ টি ক্লিয়ারেন্স সেলে বিক্রয়ার্থে সাজিয়ে রাখলেন। তবে এই ক্লিয়ারেন্স সেলের খবর তিনি নিজের আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের ছাড়া আর কাউকে দিলেন না। তিনি চান না যে তাঁর সংগ্রহের বস্তুগুলি কোনো অপরিচিত ব্যাক্তি কিনুক; ওনার মন অনেক আশ্বস্ত হবে এইটা জেনে যে তাঁর সংগ্রহের জিনিস তাঁর পরিচিত মানুষদের কাছেই রয়েছে।

 মেজর সান্ন্যালের এই ক্লিয়ারেন্স সেলে আজ হাজির হয়েছে বিক্রম এবং আগ্রহহীন অনুরাগ। মেজর সান্ন্যালের বাড়ির দরজার কলিং বেল টিপতেই ভিতর থেকে এক ভদ্রলোক বেড়িয়ে এলেন। লোকটির বয়স ৬০-৬৫ হবে, এক মাথা সাদা চুল কিন্তু চেহারায় বার্ধক্যের কোনো ছাপ নেই এবং শরীর এখনো যথেষ্ট বলিষ্ঠ। দরজা খুলতে খুলতে হাসি মুখে বিক্রম কে বললেন, “অবশেষে সময় পেলে আসার। বোধ করি ইনি তোমার সেই লেখক বন্ধু যার কথা বলছিলে?”

বিক্রম উত্তর দিলো, “হ্যাঁ মামা, ঠিক ধরেছো। এ হলো আমার লেখক বন্ধু অনুরাগ।“

অনুরাগ হাত জোড় করে নমস্কার করতেই মেজর সান্ন্যাল এক গাল হেসে বেশ ব্যাস্ত ভাবে বলে উঠলেন, “আরে এ কি তোমরা এখনো বাইরে দাড়িয়ে কেনো! এসো, ভিতরে এসো।“

 মেজর সান্ন্যাল ওদের কে এক প্রকাণ্ড হল ঘরে নিয়ে এলেন। ঘরটায় সারি-সারি অনেক টেবিল রাখা এবং সেই টেবিল গুলোতে পরিছন্ন ভাবে সাজানো মেজর সান্ন্যালের বিশাল এন্টিক সংগ্রহ। এই টেবিল গুলো ছাড়া ঘরটায় আর অন্য কোনো আসবাবপত্র নেই। কিন্তু লোকে লোকারণ্য থাকায় ঘরটার আয়তনের সঠিক আন্দাজ করতে অসুবিধা হলো অনুরাগের। ওর পাশে দাড়িয়ে থাকা মেজর সান্ন্যাল এবং বিক্রম নিমেষে মিলিয়ে গেলো এই অচেনা মানুষের ভিড়ে। প্রচুর লোকের সম্মিলিত কণ্ঠস্বরে ঘরটা গম গম করছে এবং সবকটি জানলা বন্ধ থাকায় ঘরের ভিতর এক গুমোট ভাবের সৃষ্টি হয়েছে।

 এত অজানা লোকের সমাগমে অনুরাগ অস্বস্তি বোধ করলো এবং তাই সে ঘরের এক ফাঁকা কোণে গিয়ে দাড়ালো। অনুরাগ কখনই ইতিহাস বা ঐতিহাসিক বস্তুর প্রতি কৌতূহল বোধ করে নি বরঞ্চ সেই ছোটবেলা থেকেই ইতিহাসের নাম শুনলেই ওর ঘুম পায়। এই সব আদ্যিকালের জিনিস ঘেঁটে যে কি লাভ হয় তা বোঝার ক্ষমতা অনুরাগের নেই আর বিক্রম কি না তাকে এন্টিক সংগ্রহের সেলে এনেছে। অনুরাগের মনে-মনে বিক্রমের উপর খুব রাগ হছিল কিন্তু সকালে যখন গাড়ি নিয়ে বিক্রম ওর বাড়ি এসেছিল তখন তার উল্লাস আর উত্তেজনা দেখে নিজের বিরক্তি প্রকাশ করতে মন চায় নি অনুরাগের। এমন সব নানা কথা ভাবতে-ভাবতে অনুরাগ নিজের চারপাশের এই লোকে লোকারণ্য গুমোট ঘরটি ছেড়ে বহু দূরে নিজের কল্পনার জগতে বিলীন হয় গেছিল; লেখকদের হয়তো এমনই হয়, কে জানে?

 হঠাৎ বিক্রমের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে গিয়ে বাস্তবিক জগতে ফিরে এলো অনুরাগ। “কি রে, এখানে একা দাড়িয়ে কি করছিস? তোর জন্য একটা দারুন জিনিস খুঁজে পেয়েছি। চল, দেখবি আয়।“ বলেই, অনুরাগের উত্তরের অপেক্ষা না করে, ওর হাত ধরে রীতিমত টানতে- টানতে ওকে হল ঘরের আর এক প্রান্তে নিয়ে এলো বিক্রম।

 সারিবদ্ধ টেবিল গুলোর সামনে এসে দাড়াতেই বিক্রম হাতের ইঙ্গিতে কিছু দেখিয়ে উত্তেজিত স্বরে বলে ওঠে, “দেখ, কি দারুন না জিনিস টা?” ওর হাতের ইঙ্গিত অনুসরণ করে অনুরাগ বুঝলো যে সামনের টেবিলে রাখা এক গোছা বিবর্ণ কাগজের উদ্দেশ্যে কথাটা বলা হয়েছে। কাগজের গোছা টা দেখে যে কেউ অনায়াসে বলে দিতে পারে যে এ এক বহু প্রাচীন হারিয়ে যাওয়া সময়ের অবশিষ্টাংশ, কালচক্রের নির্মম ছাপ স্পষ্ট দেখা যায় এই বিবর্ণ কাগজের গোছায়। কাগজ গুলো এতই ক্ষীণ যে অনুরাগের মনে হলো এই গোছা হাতে ধরলেই গুঁড়ো হয়ে বাতাসে মিলিয়ে যাবে। একাগ্র দৃষ্টিতে দেখলে বিবর্ণ কাগজের বুকে কালের স্রোতে ম্লান হয় আসা প্রাচীন দুর্বোধ্য লিপির অস্পষ্ট ছাপ এখনো বোঝা যায়।

 অনুরাগ কে বহুক্ষণ চুপ থাকতে দেখে বিক্রম আবার বললো, “পুঁথি টা প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার ভগ্নাবশেষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে ইরান ঘুরতে গিয়ে ওখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের সাথে আলাপ হয় মামার। মামার এন্টিক জিনিসের প্রতি আগ্রহ দেখে ওই প্রফেসরই মামা কে এই প্রাচীন পুঁথি টা উপহার স্বরূপ দেয়। মেসোপটেমিয়ার কোনো এক ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণ এই পুঁথি তে সংরক্ষিত করা রয়েছে। কি ফ্যাসিনেটিং না জিনিস টা! আমার মনে হলো পুঁথি টা তোর জন্য একদম উপযুক্ত, তাই দেখানোর জন্য তোকে ডেকে আনলাম।“

বিস্মিত স্বরে অনুরাগ বললো, “আমার জন্য উপযুক্ত! কি বলছিস তুই? তুই তো জানিসই যে আমার এই সব ঐতিহাসিক জিনিসপত্র বা পুঁথি-গ্রন্থ নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তাহলে আমাকে এই সব বলার কি মানে হয়?”

ধীর ভাবে বিক্রম উত্তর দিলো, “মানে আছে বলেই বলছি। তুই একদিন বলছিলিস না যে ইদানিং কোনো নতুন গল্পের আইডিয়া তোর মাথায় আসছে না, তখন তোর কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল যে সমস্যা টা সত্যি খুব গুরুতর। সেই দিন থেকেই তোর এই সমস্যার সমাধান কি করে করা যায় তাই নিয়ে ভাবছিলাম। আজ হটাৎ এই পুঁথিতে চোখ পরতেই মনে হলো, এই তো পেয়ে গেছি তোর সমস্যার সমাধান। আমার মনে হয় যে এই পুঁথিতে মেসোপটেমিয়ার ঐতিহাসিক ঘটনার যে বিবরণ লেখা আছে তা পড়লে তুই নিশ্চয়ই নতুন গল্প লেখার ইনস্পিরেশন এবং আইডিয়া পাবি।“

প্রতিবাদ জানানোর ভঙ্গিতে অনুরাগ বললো, “কিন্তু তুই তো জানিস যে আমি মূলত প্রেমের গল্প লিখি। এখন হটাৎ ঐতিহাসিক গল্প লিখলে …”

অনুরাগে কে কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়েই খানিক রুষ্ট স্বরে বিক্রম বললো, “আমি জানি তুই মূলত প্রেমের গল্প লিখিস। তবে এইটা জানা ছিল না যে অন্য ধরনের গল্প লেখায় তোর নিষেধ আছে।“

বিক্রমের তীক্ষ্ণ জবাবে অনুরাগের প্রতিবাদ কিছুটা দমে গেলো। খানিকক্ষণ চুপ থেকে সে বললো, “তোর সব কথাই বুঝলাম, কিন্তু আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দে। পুঁথি টা তো প্রাচীন দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা, সেইটা আমি পরবো কি করে?”

বিক্রম এক গাল হেসে উত্তর দিলো, “সে নিয়ে তোকে আর চিন্তা করতে হবে না। তোর এই সমস্যার সমাধানও আছে আমার কাছে। ইরানের যেই প্রফেসর মামা কে এই পুঁথি উপহার দিয়েছিল সেই প্রফেসরই পুঁথির একটা ইংরেজি ট্রান্সলেশনের কপি দেয় মামা কে। টেবিলে পুঁথির পাশে যেই ডায়েরি রাখা আছে সেইটাই ওই ইংরেজি ট্রান্সলেশনের প্রতিলিপি।“

খানিক চুপ থেকে বিক্রম আবার বললো, “তোর সব প্রশ্নের উত্তর পেলি তো? না আরও কিছু প্রশ্ন এখনো বাকি আছে?”

অনুরাগ কোনো উত্তর দিলো না। ওকে ইতস্তত করতে দেখে বিক্রম নরম গলায় বললো, “অত দ্বিধা কেনো করছিস অনুরাগ? আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে তুই প্রেমের গল্প ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ের গল্প নিপুণ ভাবে লিখতে সক্ষম হবি। তা ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ের গল্প নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট না করলে বড় লেখক হবি কি করে?”

অনুরাগ বিষণ্ণ স্বরে বললো, “এই পুঁথির দাম তো প্রচুর হবে। এইটা কেনার সাধ্য আমার নেই।“

“তোকে দাম নিয়ে কিছু ভাবতে হবে না। তুই এবার একটা অসাধারণ গল্প লিখে তোর সব পাঠকদের একেবারে চমকে দে। … আছা তুই একটু দাঁড়া, আমি মামার সাথে কিছু কথা বলে আসি।“ বলেই অচেনা মানুষের ভিড়ে নিমেষে হারিয়ে গেলো বিক্রম।

      ***********

 সবে ডিনার সেরে হাতে পুঁথির ইংরেজি ট্রান্সলেশনের কপি নিয়ে চেয়ারে বসেছে অনুরাগ। আসল পুঁথিটা স্বযত্নে আলমারির ভিতর ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। পুঁথির অবস্থা এতই ভঙ্গুর যে সেইটা নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করার সাহস হয় নি অনুরাগের। পুঁথির দাম কত পড়লো তা সে বিক্রম কে হাজার বার জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পায় নি। তবে বিক্রম যে তার সান্ন্যাল মামার থেকে খুব বেশি কিছু ডিসকাউন্ট পায় নি তা অনুরাগ ওর মুখ দেখেই বুঝেছিল। নাহ! বিক্রম ছেলে টি সত্যি বড় ভালো, তা না হলে আজ-কালকার দিনে কে-ই বা অপরের জন্যে অত করে। বন্ধু তো দূরের কথা, নিজের পরিজনের খবরই কতজন রাখে আজকাল?

 ট্রান্সলেটেড প্রতিলিপি টি খুলে পড়তে আরম্ভ করলো অনুরাগ। সহজ সরল ইংরেজি তে এক প্রাচীন যুগের বীভৎস ইতিহাসের হৃদয়বিদারক বর্ণনার ভারে প্রতিলিপির প্রত্যেক পাতা যেন মুরছে পড়েছে। প্রতিটি অক্ষর নীরব ক্রন্দন করে সাক্ষী দিলো এক নৃশংস ঐতিহাসিক কাহিনীর।

 প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার অন্তর্গত ছোট-বড় বিভিন্ন রাজ্য ছিল, এমন-ই এক রাজ্য ছিল এসিরিয়া। ৭৬৫ খ্রিস্টপূর্বে এক ভয়াবহ মহামারী তে আক্রান্ত হয় এসিরিয়া রাজ্য। মাসের পর মাস নিরঙ্কুশ ছড়াতে থাকা এই মহামারী তে রাজ্যের অর্ধেক শতাংশের বেশি জনসংখ্যা প্রাণ হারায়। নিজের রাজ্যের এবং প্রজাদের এমন দুর্গতি দেখে ভীষণ বিচলিত হয়ে পড়ে এসিরিয়ার রাজা। রাজার দৃঢ় বিশ্বাস যে ঈশ্বরের কুপিত দৃষ্টি পড়েছে এসিরিয়ায়, তাই এমন দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁদের। রাজার মনে হয় যে এই মহামারী থেকে নিস্তার পাওয়ার একটাই উপায় আছে; এবং সে উপায় হলো ঈশ্বর কে সন্তুষ্ট করে ওনার ক্রোধ শান্ত করা। অবশেষে, এই বিষয়ে পরামর্শ করতে রাজা নিজের রাজ্যের প্রধান পুরোহিত কে ডেকে পাঠায়। পুরোহিতও রাজার সাথে এক মত হয় যে এসিরিয়ার এই দুর্ভাগ্যের কারণ হলো ঈশ্বরের ক্রোধ এবং ঈশ্বর কে পরিতুষ্ট করতে পুরোহিত রাজার থেকে এক বিশেষ অনুষ্ঠান করার অনুমতি চেয়ে নেয় যা সে বিচলিত রাজার থেকে অনায়াসে পেয়ে যায়।

 এই সাক্ষাৎকারের দু দিন পর এসিরিয়ার সবথেকে বড় এবং প্রখ্যাত মন্দিরে এক বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে প্রচুর পরিমাণে অন্ন, খাদ্যসামগ্রী, সোনা এবং নানা বহুমূল্য অলঙ্কার, ইত্যাদি উৎসর্গ করা হয়। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের মুখ্য আকর্ষণ ছিল দেবতাদের প্রকাণ্ড মূর্তির সম্মুখে বিষণ্ণ মুখে আসনে বসে থাকা এক বলিষ্ঠ যুবক। রুষ্ট দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে এই যুবক-ই ছিল অনুষ্ঠানের প্রধান অর্ঘ্য। মহামারীর সময় এমন স্বাস্থ্যবান বলিষ্ঠ যুবক খুঁজতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছিল পুরোহিতদের কিন্তু ওদের পরিশ্রম ব্যর্থ হয় নি, এই যুবক কে দেখা মাত্রই অবিলম্বে ওকে গ্রেপ্তার করে জোর করে মন্দিরে নিয়ে আসা হয়েছিল। প্রধান পুরোহিতের মতে এই যুবকের বলি পেয়ে তুষ্ট হবে কুপিত দেবতারা। তবে এই বলি তে সাধারণ নরবলির মতো যুবকের গলা কেটে দেওয়া হবে না, এই বলি দেওয়া হবে বিশেষ এক পদ্ধতি মেনে।

 অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার পর যুবকটি কে একটা ছোট, অন্ধকার, জানলা-বিহীন ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘরে ঢুকেই যুবকটি প্রচণ্ড ছটফট করতে লাগলো, ওকে সামলাতে দুটো প্রহরী তৎক্ষণাৎ দু দিক থেকে ওকে চেপে ধরলো। এর খানিক পর আর একটা প্রহরী হাতে একটা বড় চাদর নিয়ে ঘরে ঢুকলো এবং সেই চাদর দিয়ে যুবকটির আপাদমস্তক ঢেকে দিলো। যুবকের তীক্ষ্ণ চিৎকারে ছোট ঘরটা গম গম করতে লাগলো। ওকে ওই অবস্থায় ফেলে রেখে প্রহরীরা ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে চলে গেলো।

 এই ঘটনার তিন দিন পর প্রহরীরা দরজার তালা খুলে ঘরে ঢুকে দেখে মেঝে তে পড়ে রয়েছে আপাদমস্তক চাদরে ঢাকা যুবকের মৃতদেহ। মৃত্যুর নৃশংসতা দেহটি কে এত বিকৃত করে দিয়েছে যে এই দেহের সাথে তিন দিন আগেকার যুবকটির মিল খুঁজে পাওয়া বড়ই কঠিন। মৃতদেহটা স্ফীত হয়ে গেছে এবং সারা দেহ জুড়ে বড়-বড় ফোঁড়া। কিছু ফোঁড়া ফেটে যাওয়ায় দেহ ঢাকার চাদরটি রক্ত এবং পূঁযে লেপে গিয়েছে। মৃত্যু যন্ত্রণার ছাপ সারা দেহে স্পষ্ট বোঝা যাছে, সে এক ভীষণ বীভৎস দৃশ্য। নিঃসন্দেহে যুবকের মৃত্যু প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়েই হয়েছে, তবে প্লেগ রোগে তাকে ইছাকৃত ভাবে আক্রান্ত করানো হয়েছিল। যে চাদর দিয়ে প্রহরীরা যুবকের আপাদমস্তক ঢেকে দিয়েছিল সেই চাদর আসলে ব্যবহার করা হয়েছিল প্লেগ রোগে আক্রান্ত অন্য এক ব্যক্তির মৃত্যু শয্যায়। অতএব সেই ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত চাদরের সংস্পর্শে আসতেই যুবকটিও প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে এবং শীঘ্রই মৃত্যু তাকে গ্রাস করে।

 যুবকের মৃত্যু সংবাদ পেতেই প্রধান পুরোহিতের মন উল্লসিত হয় ওঠে। সে নিশ্চিত যে এই বিশেষ পদ্ধতিতে নরবলির অনুষ্ঠান নিপুণ ভাবে সম্পন্ন হওয়ায় ক্ষুব্ধ দেবতারা তুষ্ট হয়েছে এবং তাঁদের কৃপায় এসিরিয়ার বিপদ খুব শীঘ্রই কেটে যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এসিরিয়ার বিপদ কাটতে আরও কয়েক মাস সময় লাগলো এবং সেই সময়ে আরও হাজার-হাজার মানুষ কে গ্রাস করলো মহামারী। সেই মারক ব্যাধি থেকে অবশেষে নিস্তার পাওয়ায় এসিরিয়ার রাজা দেবতাদের উদ্দেশ্যে এক প্রকাণ্ড মন্দির নির্মাণের আদেশ দেয় এবং সেই মন্দির নির্মাণে এসিরিয়ার সমস্ত জনগণ সাহায্য করে কারণ তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে যুবকের বলি পেয়ে প্রসন্ন হয়ে ঈশ্বর তাদের মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন।

 পড়া শেষ করে ট্রান্সলেটেড কপিটা টেবিলে নামিয়ে রাখলো অনুরাগ। রাত তখন প্রায় বারোটা বাজছে। এমন নৃশংস ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পড়ে অনুরাগের মাথা ঝিমঝিম করছে। ঘরের আলো নিভিয়ে শুতে চলে গেলো সে কিন্তু শুয়েও ঘুম এলো না। চোখের সামনে বারবার এসিরিয়ার সেই যুবকের ছবি ভেশে উঠলো, ওর হৃদয়বিদারক চিৎকার যেন শুনতে পেলো অনুরাগ। চোখ বুঝলে কেবলই রক্ত এবং পূঁযে লেপা চাদরে আপাদমস্তক ঢাকা যুবকের নিঃস্পৃহ দেহটি ভেশে এলো অনুরাগের চোখের সম্মুখে। বিচলিত হয় উঠে বসলো অনুরাগ। এসিরিয়ার নরবলির নৃশংসতার কথা ভেবে ওর মন ব্যাকুল হয় পড়েছে। কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাসের ফাঁদে পড়ে মানুষ কত পৈশাচিক কাজই অনায়াসে করতে পারে। তবে এইটা ভাবা নিতান্তই ভুল হবে যে এমন পৈশাচিকতা মানব ইতিহাসের ব্যতিক্রমী ঘটনা বরং এর উল্টোটাই ঠিক; অর্থাৎ মানব ইতিহাস মানুষের অবিরল পৈশাচিকতার নীরব সাক্ষী। ইতিহাসে মানুষের পৈশাচিকতার প্রাচুর্য থাকার অর্থ কি এই যে মানুষ মূলত নৃশংস? তাহলে কি অনুরাগ নিজেও এসিরিয়ার পুরোহিতদের মতো নিষ্ঠুর আর স্বার্থপর? কথাটা ভাবতেই শিউরে উঠলো অনুরাগ।

 দার্শনিক ভাবনা চিন্তায় মগ্ন থাকার দরুন রাতের অন্ধকার ফুরিয়ে আকাশে ভোরের ক্ষীণ আলো কখন ফুটে উঠলো তার টের পেলো না অনুরাগ। রাতে ঘুম না হওয়ায় প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা আর চোখ জ্বালা করছে কিন্তু তা বলে সে আজকের দিনটা নষ্ট করতে পারবে না। ওর হাতে আর একদম সময় নেই, যে করেই হোক তিন দিনে একটা গল্প লিখে সম্পাদক কে পাঠাতেই হবে। তাই অগত্যা এক কাপ কফি বানিয়ে এনে ল্যাপটপ খুলে লিখতে বসলো অনুরাগ। তার মাথায় এসিরিয়ার নরবলির সম্বন্ধে নানা চিন্তা ভিড় করে থাকা সত্তেও একটা অক্ষরও টাইপ করতে পারলো না। এসিরিয়ার যুবকের রক্তাক্ত বিকৃত মৃতদেহের ছবি ছাড়া আর অন্য কিছুই মাথায় আসছে না অনুরাগের। ঘণ্টার পর ঘন্টা ল্যাপটপের সম্মুখে বসে থেকেও গল্পের একটা লাইনও লিখতে পারে নি অনুরাগ। অবশেষে বিরক্ত হয় ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতর পায়চারি করতে আরম্ভ করলো সে। হতাশা চেপে ধরেছে তাকে, শত চেষ্টা করেও গল্প কিছুতেই লিখতে পারছে না সে। তবে কি এবার সত্যি গল্প পাঠানো হবে না সম্পাদক কে? ওর লেখক হওয়ার স্বপ্ন কি অপূর্ণ থেকে যাবে?

 হতাশায় কাহিল হয় চেয়ারে বসতেই ওর চোখ পড়লো টেবিলে রাখা পুঁথির ট্রান্সলেটেড কপিটার দিকে। কপিটা হাতে তুলে বহুক্ষণ ওটার হলদেটে পৃষ্ঠাগুলোর দিকে এক দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইলো অনুরাগ যেন কোনো গভীর ভাবনায় মগ্ন হয় আছে সে। তারপর হঠাৎ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে আবার ল্যাপটপ খুলে বসলো। কিন্তু এবার আর সে পাথরের মূর্তি হয়ে ল্যাপটপের সম্মুখ বসে রইলো না বরং ঝড়ের গতি তে টাইপ করে গেলো পাতার পর পাতা। একনাগাড়ে দীর্ঘ তিন ঘন্টা টাইপ করার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো অনুরাগ। অবশেষে গল্প লেখা শেষ করতে পেরেছে সে, এখন শুধু সম্পাদককে মেল করলেই কাজ সম্পন্ন হবে। ল্যাপটপের পাশে খুলে রাখা ট্রান্সলেটেড কপির দিকে তাকাতেই এক রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো অনুরাগের মুখে।

 পৃথিবীর সব গল্পই যে মৌলিক হতে হবে এমন তো কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। অনুরাগ নিজেও স্বীকার করছে যে সে চুরি করেছে কিন্তু এর দরুন তার মনে কোনো অনুশোচনা বোধ নেই। হারিয়ে যাওয়া এক প্রাচীন সভ্যতার পুঁথির সাথে তার সদ্য লেখা গল্পের অক্ষরে- অক্ষরে মিল থাকা কি খুব বড় অপরাধ? অন্তত অনুরাগ তা মনে করে না।

     ***********

 পত্রিকা প্রকাশের পর এখনো এক সপ্তাহ হয় নি কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রচুর ফ্যান মেল পেয়েছে অনুরাগ। এইটা অনুরাগের জীবনের এক অপ্রতিম অভিজ্ঞতা কারণ এর আগে ফ্যান মেল পাওয়া তো দূরের কথা কখনো বন্ধু পরিজনদের মুখেও নিজের লেখার প্রশংসা শোনে নি। দু দিন আগে সম্পাদক নিজে ফোন করে অনুরাগ কে তার গল্প জনপ্রিয় হওয়ায় অভিনন্দন জানায় এবং তার সাথে আর একটি সুখবরও দেয় যে পরের মাসের সংখ্যায় অনুরাগের গল্পই হবে তাঁদের পত্রিকার মুখ্য আকর্ষণ।

রাতারাতি সাফল্য অনুরাগের দরজার কড়া নেড়েছে। এক সময় অনুরাগের লেখা প্রায় সব প্রকাশক বাতিল করেছিল কিন্তু আজ তার গল্প প্রকাশ করতে সবাই আগ্রহী। তাকে অভিনন্দন জানাতে আসা চেনা-পরিচিতদের সমাগমে তার ঘরে এখন প্রতি সন্ধ্যায় জমজমাট আসর বসে। ইতিমধ্যে দু-একটা অটোগ্রাফও দেওয়া হয় গেছে অনুরাগের। সারা দিন ফোন, ই-মেলের উত্তর দিয়ে এবং অথিতি আপ্যায়ন করে বেশ সুখময় ব্যাস্ততার মাঝেই দিন কাটছিল অনুরাগের।

প্রতিদিন ঘরে বহু আগন্তক এলেও তাঁর জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না অনুরাগ। তাই সেইদিন দরজা খুলে হটাৎ তাঁকে সামনে দাঁড়ানো দেখে হতভম্ব হয় কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলো অনুরাগ। তাঁর “ভিতরে আসতে পারি?” শুনে ব্যস্তসমস্ত হয়ে তাঁকে ভিতরে এনে সোফায় বসালো অনুরাগ।

অনুরাগের সম্মুখে সোফায় বসা ভদ্রলোকটির নাম শান্তনু মল্লিক। ৭০-৭২ বছরের গম্ভীর প্রকৃতির ক্ষীণ চেহারার মানুষটি অনুরাগের প্রতিবেশি। ইনি একা থাকেন এবং নিতান্ত দরকার ছাড়া কোনোদিনো কারোর সাথে যেচে কথা বলেন না। অকারণে কারোর বাড়ি এসে আড্ডা মেরে সময় নষ্ট করার লোক ইনি নন। তাই হটাৎ আজ ওনাকে নিজের দরজায় দেখে খুব অবাক হয়েছে অনুরাগ।

ঘরের নীরবতা ভেঙে বলে উঠলেন শান্তনু মল্লিক, “তোমার গল্প পড়লাম। ভালো হয়েছে।“

মুখে কিছু না বলে হেসে অভ্যর্থনা জানালো অনুরাগ।

একটু ইতস্তত করে বললেন শান্তনু মল্লিক, “আমার একটা প্রশ্ন ছিল, কিছু মনে করোনা।“

–“না, কিছু মনে করবো কেন। আপনি নির্দ্বিধায় বলুন আপনার যা বলার।“

–“আছা, গল্পটা কি সত্যি তুমি লিখেছ?”

প্রশ্নটা শুনে বেশ উত্তেজিত হয়ে অনুরাগ বললো, “কি বলতে চাইছেন আপনি? আমি গল্পটা চুরি করেছি?”

বিনম্র স্বরে উত্তর দিলেন শান্তনু মল্লিক, “না না, তা কেন বলবো? আসলে…”

মল্লিক বাবু কে চুপ হয়ে যেতে দেখে বিরক্ত গলায় অনুরাগ বললো, “যা বলতে চান সোজাসুজি বলুন।“

খানিক্ষণ চুপ থেকে আবার বললেন শান্তনু মল্লিক, “আমি ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাসের প্রফেসর ছিলাম। প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস আমার এরিয়া অফ স্পেশালাইজেশন। এই বিষয়ে প্রচুর রিসার্চ করেছি এবং বহু ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে আমার পেপার পাবলিশ হয়েছে। তাই যখন শুনলাম তুমি প্রাচীন সভ্যতার এক বিশেষ ঘটনা সম্বন্ধে গল্প লিখেছ খুব আগ্রহ নিয়ে পড়লাম তোমার গল্প। কিন্তু তোমার গল্প পড়ে মনে হলো এমন গল্প আমি আগে কোথাও পড়েছি। তারপর মনে পড়লো ৬-৭ বছর আগে এক এন্টিক কালেক্টরের সংগ্রহ খুব কাছের থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই সংগ্রহে মেসোপটেমিয়ার এক পুঁথিও ছিল। প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসে আমার বিশেষ আগ্রহ থাকার দরুন পুঁথিটা ওনার থেকে চেয়ে নিয়ে সেটার বিশেষ অধ্যয়ন করেছিলাম। সেই পুঁথির সাথে তোমার গল্পের আশ্চর্য রকম মিল আছে।“

অনুরাগ ঢোক গিলে বললো, “আপনি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস সম্বন্ধে হাজার-হাজার বই পড়েছেন তাই আমার গল্প আপনার পরিচিত মনে হতেই পারে। কিন্তু তাই বলে আপনি আমাকে চুরির অপবাদ দিতে পারেন না।“

উদ্বিগ্ন স্বরে শান্তনু মল্লিক বললেন, “না, না, তুমি ভুল বুঝছ আমাকে। আমি তোমাকে চুরির অপবাদ দিতে আসি নি। আমি জানি পুরো ব্যাপারটা হয়তো নিছক কাকতালীয় তবু আমার মনে হলো তোমাকে সব কিছু জানিয়ে রাখা উচিত। জানি না তোমাকে কতো টা বোঝাতে পারবো তবু চেষ্টা করবো সব খুলে বলার। প্রাচীন যুগে মানুষের বিশ্বাস ছিল যে পৃথিবীর প্রত্যেক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ ঈশ্বরের ক্রোধ এবং সব দুর্যোগ থেকে নিস্তার পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো কুপিত ঈশ্বর কে তুষ্ট করা। সেই সব দুর্যোগ থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য প্রত্যেক প্রাচীন সভ্যতার নিজস্ব ইষ্টদেবতা ছিল এবং তাঁদের তুষ্ট রাখা হতো নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুযায়ী। তোমার গল্পে যে বিশেষ পদ্ধতির নরবলির বিবরণ আছে সেই বলি উৎসর্গ করা হতো নেরগাল কে। নেরগাল ছিল মেসোপটেমিয়ার মহামারী এবং বিধ্বংসের দেবতা। এই বলির এক জরুরী নিয়ম আছে যেইটা ছাড়া বলি সম্পন্ন হতো না কিন্তু এর উল্লেখ তোমার গল্পে নেই এবং যা সম্ভবত তোমার অজানা। নেরগালের উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হলে পুঁথি তৈরি করা হতো, যেই পুঁথিতে বলির বিস্তারিত বিবরণ লেখা থাকতো এবং সেই পুঁথি নেরগাল কে উৎসর্গ করে বলি সম্পন্ন করা হতো। কিন্তু মহামারীর কারণে যদি বলির জন্য উপযুক্ত স্বাস্থ্যবান মানুষ না পাওয়া যেতো তাহলে পুরোহিতরা বলি না দিয়েই পুঁথি তৈরি করে নেরগাল কে উৎসর্গ করতো এবং বলির উপযুক্ত মানুষ পেলেই তাঁর বলি দিয়ে পুরোহিতরা নিজেদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতো। এমন আগাম তৈরি পুঁথি কে প্রতিশ্রুতি পুঁথি বলা হতো। পুরোহিতদের মতে প্রতিশ্রুতি পুঁথি লিখলে বলি দেওয়া অনিবার্য অন্যথা যে পুঁথি লেখে তাঁর জীবনে ভীষণ বিপদ ঘনিয়ে আসে।“

কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান্তনু মল্লিক বলে চললেন, “তোমার গল্পের সাথে মেসোপটেমিয়ার সেই পুঁথির মিল খুঁজে পাওয়ায় আমি খুব আচম্বিত হয়ছি। আমি জানি না তোমার গল্পের সাথে এক আদিকালীন পুঁথির হুবহু মিল কি করে হতে পারে, তবে আমার বিশ্বাস যে তুমি তোমার অজান্তেই মেসোপটেমিয়ার প্রতিশ্রুতি পুঁথি লিখেছ। তাই তোমাকে সতর্ক করতে আজ আমার এইখানে আসা।“

অনুরাগের বিষণ্ণ মুখ দেখে মল্লিক বাবু নরম স্বরে বললেন, “তুমি চিন্তা কর না। সব সমস্যারই সমাধান থাকে। তুমি বরং কাল বিকালে আমার বাড়ি চলে এসো। আমার বাড়িতে এই বিষয় প্রচুর বই আছে, দুজনে মিলে পরামর্শ করে কোনো উপায় নিশ্চয়ই বের করবো।“

     ***********

 পরের দিন অনুরাগ যখন শান্তনু মল্লিকের দরজায় এসে দাঁড়ায় তখন বাজে রাত আটটা। অনুরাগ কে দেখে সামান্য অপ্রসন্ন স্বরে মল্লিক বাবু বললেন, “বিকেল থেকে তোমার প্রতীক্ষায় বসে ছিলাম। ভাবলাম আজ হয়তো আর আসবে না। যাই হোক, এখন আর বাইরে দাঁড়িয়ে থেকো না, ভিতরে এসে বসো।“

 শান্তনু মল্লিকের ছোট এক তলা ঘরের ড্রয়িং রুমের সোফায়ে এসে বসলো অনুরাগ। পরিষ্কার পরিছন্ন ঘরটার তিন দিকের দেওয়াল জুড়ে রয়েছে সারি-সারি কাঠের তাক এবং সেই তাকগুলি তে সাজিয়ে রাখা আছে প্রচুর বই। ঘরের আসবাবপত্র বলতে রয়েছে একটা সোফা সেট, তার সামনে রাখা একটা কফি টেবিল এবং ঘরের অন্য প্রান্তে রাখা ফুলবিহীন এক প্রকাণ্ড ফ্লাওয়ার ভাস।

 শান্তনু মল্লিক সোফায় বসতেই অনুরাগ বলে উঠলো, “আপনার বইয়ের কালেকশন তো দারুন।“

ক্ষীণ হেসে মল্লিক বাবু উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, এই আমার জীবনের অমূল্য সম্পদ।“

–“আমি কি দেখতে পারি?”

–“নিশ্চয়ই।“

অনুরাগ উঠে তাকের সামনে দাঁড়িয়ে বইগুলোর নাম খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে আরম্ভ করলো। মল্লিক বাবু একনাগাড়ে নেরগাল এবং প্রতিশ্রুতি পুঁথি সম্বন্ধে বলে চললেন কিন্তু ওনার একটা কথাও অনুরাগের কানে গেলো না। সে কেবল বিস্মিত দৃষ্টি তে ঘরের চতুর্দিক ঘুরে-ঘুরে কি যেন দেখতে লাগলো। হটাৎ ওনার কথার অবিরল স্রোত থামিয়ে অনুরাগ বলে উঠলো, “ফ্লাওয়ার ভাসটা তো প্রচণ্ড ভারি। কোথায় পেলেন এত ভারি ভাস?”

“আমার এক ছাত্র দিয়েছিল। বিদেশ থেকে আনা।“ দ্রুত উত্তর দিয়েই মল্লিক বাবু আবার হারিয়ে গেলেন মেসোপটেমিয়ার ইতিহাসের অবিরল প্রবাহে।

 খানিক্ষণ বাদে একটা ‘ধপ’ শব্দ থামিয়ে দিলো শান্তনু মল্লিকের কথার অবিরল স্রোত, অকস্মাৎ নিস্তব্ধতা নেমে এলো ঘরে। সোফায়ে বসা ওনার ক্ষীণ শরীরটি ধীরে-ধীরে নুয়ে পড়লো সামনে রাখা কফি টেবিলর উপর। মাথার থেকে গলগলিয়ে রক্ত ঝরায় রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে ওনার শার্ট এবং চারপাশের মেঝে। ঠিক পিছনে দাঁড়ানো অনুরাগের হাতে ধরা ভাসটাও রাঙা হয় গেছে শান্তনু মল্লিকের রক্তে। ভাসটা পাশে নামিয়ে রেখে আচমকা অট্টহাসি হেসে উঠলো অনুরাগ। তারপর টেবিলে নুয়ে পড়া নিস্পৃহ দেহটির দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলে চললো, “আমি যে গল্পটা চুরি করেছি আপনি ঠিকই ধরেছিলেন। আসলে কি জানেন, একজন লেখকের জীবনে গল্প চুরির অপবাদের থেকে বেশি লজ্জাজনক কিছু হয় না; আমার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। তা ছাড়া, আমাকে নেরগালের ক্রোধের হাত থেকে রক্ষা করতে আপনার এত আগ্রহ দেখে ভাবলাম নেরগালের উৎসর্গে আপনার থেকে বেশি উপযুক্ত অর্ঘ্য আর কেউ হতে পারে না। তাই নিজের মান এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে আপনার বলি দিতে হলো আমাকে। কিছু মনে করবেন না কিন্তু।“

কথা শেষ হতেই এক পৈশাচিক হাসি তে বিকৃত হয়ে গেলো অনুরাগের মুখ।

     ***********

 তেরো তলা ফ্ল্যাটের সি ফেসিং ব্যালকনি তে বসে কফি কাপে চুমুক দিছে অনুরাগ। মুম্বাই শিফট করেছে প্রায় তিন বছর হতে যায়। এত দিন ভাড়া বাড়িতে থেকে অবশেষে নিজের ঘর কিনতে পারায় অনুরাগের মন ইদানিং বেশ ফুরফুরে। অনুরাগ এখন দেশের একজন নাম করা লেখক। ওর লেখা প্রায় প্রত্যেকটা উপন্যাস বেস্ট সেলার লিস্টের প্রথম স্থানে থাকে। ইতিমধ্যে প্রচুর সাহিত্য সম্মান এবং পুরস্কারও পেয়েছে সে।

 জীবনের ব্যাস্ততার ফাঁকে অবসর মুহূর্তগুলি ব্যালকনির নীরবতায় বসে কাটাতে পছন্দ করে অনুরাগ। এইখানেই বসে সে নিজের নতুন উপন্যাসের গল্প, চরিত্র, পটভূমি, ইত্যাদির পরিকল্পনা করে। কিন্তু আজ সে কোনো নতুন উপন্যাসের কথা ভাবছে না, আজ তার মন ডুবে রয়েছে নিজের অতীতের সাগরে। চার বছর আগে একটা ঐতিহাসিক গল্প লিখে রাতারাতি সাফল্য পাওয়া, প্রথম ফ্যান মেল, প্রথম অটোগ্রাফ দেওয়া, এমন কত স্মৃতি তার মনে আজ ভিড় করে আছে। এত সুখময় স্মৃতির ভিড়ে হটাৎ শান্তনু মল্লিকের নুয়ে পড়া ক্ষীণ দেহটির কথা মনে পরতেই চমকে উঠলো অনুরাগ।

 মৃত্যুর পরের দিন সকালে কাজেরলোক এসে যখন ওনার রক্তাক্ত মৃতদেহ উদ্ধার করেছিল কি হাঙ্গামা-ই না বেঁধেছিল সারা পাড়া জুড়ে। সবার মুখে একটাই প্রশ্ন ছিল, “ওনার বাড়িতে তো কারোর যাওয়া আসা নেই, তবে এই জঘন্য কাজ করলো কে?” মুহূর্তের মধ্যে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ হয়ে গিয়েছিল তাদের পাড়া। গোবেচারা অনুরাগ অবশ্য পুলিশের সন্দেহের দৃষ্টির ধারে কাছেও ছিল না। প্রচুর তদন্ত, তল্লাশি এবং জেরা করেও পুলিশ এই খুনের কোনো কিনারা করতে পারে নি। শেষমেষ এই আত্মীয় পরিজন বিহীন বৃদ্ধের মৃত্যু রহস্য অমীমাংসিত থেকে গেলো।

 এখন অনুরাগের ভাবতেও অবাক লাগে যে কতো অনায়াসে কাজটা করেছিল সে। মল্লিক বাবু মেসোপটেমিয়ার দেবতা, বলি ইত্যাদি সম্পর্কে যে সব প্রলাপ বকতেন তা অনুরাগ একেবারেই গ্রাহ্য করতো না। কিন্তু মল্লিক বাবুর তার গল্প চুরি করার ব্যাপারটা ধরে ফেলায় সে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিল। অনুরাগের মনে ভয় ছিল যে মল্লিক বাবু তার গল্প চুরির ব্যাপারটা সকল কে জানিয়ে দেবেন এবং তার ক্যারিয়ার শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয় যাবে। সেই ভয়েতেই তো অনুরাগ এমন জঘন্য কাজ করতে বাধ্য হয়েছিল, তা না হলে কি আর … থাক সেই সব কথা। অতীত ঘেঁটে আর কি লাভ হবে?

 সমুদ্রের দিক থেকে ভেসে আসা মৃদু বাতাসে চোখ বুজে আসছিল অনুরাগের। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত আটটা বাজছে। ‘খুব একটা খিদে নেই। আজ ডিনার না করলেও চলে,’ ভেবেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। শরীর অবসন্ন লাগায় ঘরে ঢুকে সোজা নিজের বেডরুমে চলে গেলো এবং খাটে উপুড় হয় শুয়ে একটা উপন্যাস পড়তে আরম্ভ করলো। পড়তে-পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছিল তা টের পায় নি সে।

 ঘুম ভাঙলো অসহ্যকর গরম এবং তীব্র দুর্গন্ধে। চোখ খুলেই অনুরাগ দেখলো চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এতটাই অন্ধকার যে সে নিজের হাত পা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে না। ‘কি হলো ব্যাপারটা? লোডশেডিং হয়েছে নাকি?’ ভেবেই খাটের পাশে রাখা টেবিলের থেকে মোবাইল নেওয়ার উদ্দেশ্যে হাত বাড়ালো। কিন্তু কি আশ্চর্য ব্যাপার, নিজের হাত একটুও নাড়াতে পারলো না সে। শুধু হাত নয়, নিজের শরীরের কোনো অঙ্গ-ই নাড়াতে পারলো না অনুরাগ। তার মনে হলো এই নিকষ কালো অন্ধকারে অসংখ্য অদৃশ্য হাত তার সারা শরীর চেপে ধরে রেখেছে। ভয়ে, উত্তেজনায় ওর সারা শরীর দরদর করে ঘামছে এবং সেই তীব্র দুর্গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে।

হটাৎ চারপাশের গুমোট নিস্তব্ধতা কে ছিন্ন করে ভেসে এলো পায়ে হাঁটার একটা ক্ষীণ শব্দ। শব্দটা ধীরে-ধীরে অনুরাগের বেডরুমের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো এবং সেই সাথে আরও প্রবল হয়ে উঠলো ঘরের দুর্গন্ধ। খানিকক্ষণ পর আস্তে করে খুলে গেলো বেডরুমের দরজা। সেই দিকে তাকাতেই অনুরাগের শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমেল স্রোত নেমে গেলো। দরজার মুখে দাঁড়ানো একটা ছায়ামূর্তি এবং সে মন্থর পায়ে এগিয়ে আসছে অনুরাগের দিকে। ছায়ামূর্তি আরও কাছে এগিয়ে আসতেই অনুরাগ অস্পষ্ট ভাবে দেখতে পেলো তাঁকে। কিন্তু যা দেখলো তাতে সে নিজের চোখ কে-ই বিশ্বাস করতে পারলো না। তার দিকে ধীর গতি তে এগিয়ে আসছে শান্তনু মল্লিক এবং তার হাতে ধরা রয়েছে একটা অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত চাদর। তৎক্ষণাত অনুরাগের চোখের সামনে ভেসে উঠলো চার বছর আগে পড়া এসিরিয়ার পুঁথিতে বিবৃত এক নৃশংস ঘটনার ছবি। এই মুহূর্তে তার তেরো তলা ফ্ল্যাটের বেডরুমে যা ঘটছে সব যেন এসিরিয়ার সেই পুরাকালীন ঘটনার পুনরাবৃত্তি। কথাটা মনে হতেই অনুরাগ প্রাণপণে উঠে বসার চেষ্টা করলো কিন্তু অসংখ্য অদৃশ্য হাত গুলো তাকে সজোরে চেপে ধরে রাখলো। এমন সময় হটাৎ পাশে তাকাতেই ভয়ে কাঠ হয়ে গেলো অনুরাগের শরীর; অনুরাগ কে আপাদমস্তক চাদরে ঢেকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ওর খাটের ঠিক পাশে হাতে চাদর তুলে দাঁড়িয়ে আছেন শান্তনু মল্লিক। এই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ করে প্রাণভিক্ষার শেষ আর্জি জানালো অনুরাগ। কিন্তু শান্তনু মল্লিক এই মর্মভেদী আর্তনাদ কে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য না করে যন্ত্রমাফিক নামিয়ে দিলো গন্ধযুক্ত রক্ত পূঁযে লেপা চাদর অনুরাগের গায়ে।

খানিক্ষণ বাদেই জ্ঞান হারালো অনুরাগ। কিন্তু অচেতন হওয়ার আগে তার মনে হয়েছিল তার কানে যেন ভেসে আসছে অস্পষ্ট স্বরে কয়েকটি কথা, “তুমি আমার বলি পদ্ধতি মেনে দাও নি, তাই নেরগাল সেই বলি গ্রহণ করে নি। সুতরাং পদ্ধতি অনুযায়ী তোমার বলি নেরগাল কে উৎসর্গ করে অবশেষে তোমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলাম।“

   ***********সমাপ্ত***********

© Sreya Mukherjee


Comments

Popular posts from this blog

Female Angst: The Social Cost of Rape

The Red Wine

The Motherhood Project: Introduction