My Take - কাছের মানুষ

সুচিত্রা ভট্টাচার্যের লেখা 'কাছের মানুষ' চিরকাল আমার হৃদয়ের খুব কাছে থাকবে। প্রথম কারণ তো এই যে এইটাএকটা অসাধারণ উপন্যাস আর দ্বিতীয় কারণ, এইটা আমার পড়া প্রথম বাংলা উপন্যাস।
এই কিছুক্ষণ আগেই বইটা পড়া শেষ করলাম। বইটা পরে যেই অনুভূতি হচ্ছে তা বড়োই জটিল, তাও সেই অনুভূতি ই তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
প্রথমেই বলি 'কাছের মানুষ' কেবল মাত্র উপন্যাস নয়, এইটা একটা লিভিং এন্টিটি। বইটা পড়তে পড়তে কখনও আমিও রায়বাড়ির এক সদস্য হয় উঠতাম, আবার কখনো কখনো মাধবপুরএর গ্রামঃ পরিবেশে নিজেকে পেতাম, তো কখনো আবার শুভাশিস দের শোভামণ্ডিত ফ্ল্যাটে নিস্পৃহ ছন্দার পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। বইটা পড়লেই এক জীবন্ত চলচ্চিত্র চোখের সামনে ভাসত। বইটা পড়ে নানা রকমের আবেগ মন ছুঁয়ে কোথাও বিলীন হয়ে যেত। আমি মনে করি এইটাই হল একটা ভালো উপন্যাসের কষ্টি, যেইটা পড়ে পাঠকের মনে নানা রকমের আবেগের সৃষ্টি হবে। সুচিত্রা ভট্টাচার্য বাঙালি মিডল ক্লাসের আসল ছবি তুলে ধরেছে। গল্পটা লেট 80s এর কিন্তু সময়ের স্রোতে গল্পের সমসমায়িকতা এখনো ক্ষয়ে যায় নি।
এই আধুনিক যুগে আমরা সবাই খুব স্বার্থপর হয় গেছি। শুধু নিজের টুকু ছাড়া কিছুই বুঝি না আর বুঝতে চাইও না। কিন্তু এমনি করে কি মানুষ বাঁচে? মানুষ কি এক দ্বীপ, যে সে কারোর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না রেখে বেঁচে থাকবে আদি অন্তকাল? কিন্তু দ্বীপও যে গভীর জলের তলে একে অপরের সাথে সংশ্লিষ্ট, তাহলে মানুষ কি করে নিজেকে সম্পর্কের জাল থেকে ছাড়ায়ে? আর সম্পের্কের সংজ্ঞা টা ঠিক কি? সম্পর্কের ভিত্তি কি শুধুই বিনিময়? নাকি অন্য কোনো গভীর রহস্য নিহিত রয়েছে এই ছোট শব্দটি তে? প্রতিটি মানুষ যে তার বুকের ভেতর দুঃখের একটা সমুদ্র লুকিয়ে রাখে এইটা 'কাছের মানুষের' থেকে বেশি কে তুলে ধরতে পারবে আমাদের সামনে? প্রতিটি মন যে নিজের কাছের মানুষ কে পাওয়ার জন্য আকুল হয় থাকে সেটাও তো কত সুন্দর করে তুলে ধরেছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য।
আর একটা জিনিস যেইটা আমার মন ছুঁয়ে গেছে হলো লেখিকা কি সুন্দর ভাবে প্রকৃতির চক্রের সাথে মানুষের জীবন চক্র একীভূত করেছে। এই উপন্যাসটি তে কোনো একটা চরিত্রের কর্তৃত্ব নেই, লেখিকা সবাইকে নিজের মন খুলে দেওয়ার সমান সুযোগ দিয়েছে। তাই আমরা, পাঠকেরা দেখতে পাই যে সব চরিত্রের জীবন, সমস্যা, দুঃখ একে অপরের থেকে যতই ভিন্ন হোক, সবার জীবনের মর্মস্থল কিন্তু এক। আমরা সবাই ওই দ্বীপের থেকে উৎপতিত গাছগুলোর মতো, দেখে মনে হয় আমরা সবাই পৃথক কিন্তু গভীরে আমরা সবাই একে অপরের সাথে যুক্ত, ঠিক ওই গাছগুলোর সেঁকড়ের মতো।
এই উপন্যাসটি কে পারফেক্ট বললে ভুল হবে না। উপন্যাসটি পড়ে খুবই ভাল লেগেছে আমার। তবুও আমি 5 স্টার দিলাম না কারণ সুচিত্রা ভট্টাচার্য এত স্পষ্ট ভাবে জীবনের মর্ম, কষ্ট, সংঘর্ষ কে তুলে ধরেছে যেইটা পরে আমার বুকের ভেতরটা কেমন ভারী হয় যেত। প্রতিটি চরিত্রে কে এত কাছের থেকে অনুভব করেছি যে তাদের কষ্টে আমার দম বন্ধ হয় যেত। এইটা অবশ্য লেখিকার নিপুনতা যে আমি প্রত্যেকটি চরিত্রের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। তবুও বলবো যে জীবনের মর্ম এত স্পষ্ট ভাবে ফুটে আছে এই উপনাস্যে যা দেখে আমার শিহরণ হয়, দম বন্ধ হয়ে ওঠে, আলোর কিরণ খুঁজতে থাকি এই গভীর, অতল অন্ধকারে। তাই হয়তো এই পারফেক্ট উপন্যাস কে পারফেক্ট 5 স্টার রেটিং দিতে পারলাম না, তবে 4.5 স্টারের থেকে কম রেটিং অবশ্যই দেওয়া যায় না সুচিত্রা ভট্টাচার্জির এই মাস্টার-পিএস কে।
এইটা আমার লেখা প্রথম বাংলা রিভিউ, বইটা পরে যেই সহস্র আবেগের উৎপত্তি হয়েছিল মনে সবই তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।ভুল ত্রুটি হলে ক্ষমাপ্রার্থী।
রিভিউ টা সমাপ্ত করতে চাই এই উপনাসেরই একটা লাইন দিয়ে। উপন্যাসটি তে অজস্র সুন্দর লাইন আছে যা একবারে মনে গেঁথে যায় তবুও এই লাইনটা যেন একটু বেশিই ছুঁয়ে গেছে আমায়।
"কোনোভাবে একটা তো বাঁচতেই হয়। বেঁচে থাকাটাই সুখ। বেঁচে থাকাটাই অনানন্দ।"


Comments

Popular posts from this blog

Female Angst: The Social Cost of Rape

The Red Wine

The Motherhood Project: Introduction